ডায়াবেটিস কি? ডায়াবেটিসের লক্ষণ এবং ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

ডায়াবেটিস কি? সহজ কথায় বলতে গেলে শরীরে ইনসুলিন কমে যাওয়াকেই ডায়েবেটিস বলে। মানব দেহে অগ্ন্যাশয় (Pancreas) নামে একটি অর্গান থাকে। অগ্ন্যাশয় থেকে অনেক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, ইনসুলিন তাদের মধ্যে অন্যতম। ইনসুলিনের কাজ হল রক্তে সুগারের পরিমাণ ঠিক রাখা। যদি কোন কারণে ইনসুলিন ক্ষরণ কম হয় বা এর কার্যক্ষমতা কমে যায়, তখন রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন তাকে ডায়াবেটিস বলে। ডায়াবেটিস সম্পর্কে সব খুটিনাটি জানতে যেমন – ডায়াবেটিসির লক্ষণগুলো কি কি এবং ডায়াবেটিস কমানোর উপায় ইত্যাদি আরও নানা প্রশ্নের উত্তর পেতে পুরো লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।

ডায়াবেটিস কেন হয় 

বিভিন্ন কারনেই ডায়াবেটিস হতে পারে। সেগুলো না হয় আরেকটু পর বলি, তার আগে জেনে নেই সবারই কি ডায়াবেটিস হতে পারে? এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ সবারই ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়াবেটিস মূলত ৪ ধরনের – 

  • টাইপ 1  ডায়াবেটিস
  • টাইপ 2 ডায়াবেটিস
  • গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
  • অন্যান্য টাইপ

টাইপ 1 ডায়াবেটিস: এর আরেক নাম “Insulin Dependent Diabetes” সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সী লোকদের হয়, এমনকি বাচ্চাদেরও হতে পারে। টাইপ 1 ডায়াবেটিস হওয়ার কোন নির্দিষ্ট কারণ নেই। শরীরের “Imune” সিস্টেম যখন ক্ষতিকর পদার্থ বা ব্যাকটেরিয়া ভেবে ভুলবশত  “Islets of Langerhans” ধ্বংস করে ফেলে তখন আর ইনসুলিন বের হতে পারে না। যার কারন রক্তে সুগারের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। 

টাইপ 2 ডায়াবেটিস: টাইপ 2 ডায়াবেটিস কি?  এই টাইপের ডায়াবেটিসর ক্ষেত্রে “Islets of Langerhans” এর ধ্বংস বা কোন ক্ষতি হয় না এবং ইনসুলিন ক্ষরণও থেমে যায় না। এই ক্ষেত্রে হয় ইনসুলিন ক্ষরণ আগের মতই হয় যেমনটা একজন নন – ডায়াবেটিস মানুষের ক্ষেত্রে হয়। কিন্তু টাইপ 2  ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন ক্ষরণ নরমাল থাকলেও ইনসুলিনের কাজ কার্যক্ষমতা কমে যায় বা কাজ করতে বাধা প্রাপ্ত হয় যাকে মেডিকেল সাইন্সে “Relative Deficiency of Insulin”  বলা হয়। অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনার কম নিঃসৃত হয়। একজন সুস্থ মানুষের শরীরে প্রতিদিন প্রায় ২০০ IU ইনসুলিন নিঃসৃত হয়, যদি এর কম হয় তখন ইনসুলিন তার কাজ ঠিক মত করতে পারে না । এই অবস্থাকেই টাইপ 2 ডায়াবেটিস বলে। 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তনের যে ডায়াবেটিস হয় সেটা হল গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। এটি দুই ধরনের Class A1 এবং class A2। Class A1 সাধারন ডায়েট এবং নিয়মিত ব্যায়ামেই ভাল হয়ে যায় কিন্তু class A2 এর ক্ষেত্রে ইনসুলিন নিতে হয়। 

অন্যান্য টাইপ: বলতে অন্য কারনে যে ডায়াবেটিস হয়। এ যেমন অগ্ন্যাশয়ের অসুখ থাকলে, বিভিন্ন ওষুধ (Corticosteroid,Phenoytoin) সেবনের কারনে, ভাইরাল ইনফেকশনের (Mups, Rubella)কারনে ইত্যাদি। 

এবার আসি আমাদের প্রথম প্রশ্নের উত্তরে। বিভিন্ন কারনেই ডায়াবেটিস হতে পারে যেমন – 

  •  স্থুলতা
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • বংশগত ভাবে
  • অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন 
  • বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডায়াবেটিসের ঝুকি থাকে
  • নিম্ন মাত্রার HDL কোলেস্টেরল থাকা

কিভাবে বুঝবেন আপনি টাইপ 1 কিংবা টাইপ 2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত

৩০ বছর বয়ষের উপরে ডায়াবেটিস হলে টাইপ 2 ডায়াবেটিস কারন টাইপ 1 ডায়াবেটিস সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সী লোকদের হয়। অতিরিক্ত ওজন কমা টাইপ 1 ডায়াবেটিসকে নির্দেশ করে। টাইপ 2 ডায়াবেটিসে কিছুটা ওজন কমে। টাইপ 2 ডায়াবেটিস বংশগত কিন্তু টাইপ 1 এর ক্ষেত্রে এর কোন ভূমিকা নেই। ডায়াবেটিসে সাধারন লক্ষণগুলো টাইপ 1 দেখা যাবেই কিন্তু  টাইপ 2 তে সবসময় নাও দেখা যেতে পারে। 

ডায়াবেয়াটিস মাপার নিয়ম

এতোক্ষনে হয়তো আপনাদের মন সন্দেহ ঢুকে যে আমারও কি ডায়াবিটিস আছে কিনা? কিভাবে ডায়াবেটিস মাপা হয়, সুগারে মাত্রা কত হলে বুঝবেন ডায়াবেটিস, ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল ইত্যাদি প্রশ্ন। প্রথমেই বলে নেই ডায়াবেটিস আছে কিনা তা নির্ভর করে ব্লাড সুগার লেভেলের উপর। এখন কথা হল ব্লাড সুগার কি? নামেই বুজতে পারছেন ব্লাড সুগার মানে হল আপনার রক্তে কত পরিমাণ সুগার আছে। WHO অনুযায়ী ডায়াবেটিস আছে কিনা তা ৩ ভাবে ডায়াগনসিস করা যায়। যার মধ্যে একটি হল “Blood Sugar Level” এটা আপনি নিজেও করতে পারবেন। ঘরে বসে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হলে আপনার দরকার একটি গ্লুকোমিটার। যার মাধ্যমে আপনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফলাফল পেয়ে যাবেন। গ্লুকোমিটারে থাকে একটি স্ট্রিপ, নিডল ও ইলেক্ট্রিক ডিভাইস যেটাতে ডিজিট দেখা হয়। নিডলের মাধ্যমে আঙুলের একদম উপরের অংশ (Tip of the finger) সরু ছিদ্র করে তার থেকে যে কয়েক ফোটা রক্ত বের হবে তা স্ট্রিপটিতে লাগান এবং তা গ্লুকোমিটারে প্রবেশ করান। কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখবেন ব্লাড সুগার লেভেল স্ক্রীনে দেখাচ্ছে। 
এটা দুই অবস্থায় করা যায়। একটা হল সম্পূর্ন খালি পেটে আরেকটি সকালে নাস্তার ২ ঘন্টা পর। খালি পেটে সুগারের নরমাল লেভেল 6.1 – 7.0 mmol/L এবং ভরা পেটে সুগারের নরমাল লেভেল 7.8 – 11.0 mmol/L । এর চেয়ে বেশি হলে ডায়াবেটিস আছে বলে ধরে নিতে হবে। 

ডায়াবেটিসের লক্ষণ

ডায়াবেটিসের অনেকগুলো লক্ষণ আছে । তবে যে লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারে পরামর্শ নেয়া উচিত সেগুলো এখানে দেয়া হল। 

  • ঘনঘন প্রসাব লাগাু
  • ঘনঘন তৃষ্ণা লাগা
  • ওজন কমে যাওয়া
  • ক্ষত ভাল হতে সময় লাগা ( Slow healing rate) 
  • রাগান্বিত থাকা
  • খুদামন্দা লেগে থাকা
  • মনোযোগ কমে যাওয়া
  • খুব তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে যাওয়া
  • চোখে ঝাপসা দেখা
ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

ডায়াবেটিস এমন রোগ যার  পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব নয়। তবে বিভিন্নভাবে ডায়াবেটিস কে কন্ট্রোলে রাখা যায়। 

কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার কমান: যেহেতু ডায়াবেটিস মানেই ইনসুলিনের সমস্যা। আর ইনসুলিনের কাজই হল সুগার কন্ট্রোলে রাখা। চিনি জাতীয় খাবার বর্জন করুন। সর্বোচ্চ ৫০ গ্রাম কার্বোহাড্রেট জাতীয় খাবার খাওয়া যেতে পারে প্রতিদিন যা শরীরে জন্য ক্ষতিকর নয়। 

ফাইবার জাতীয় খাবার: শাকসবজি, ফলমূল এগুলোকে ফাইবার জাতীয় খাবার বলে। ফাইবার জাতীয় খাবার রক্তে সুগারের পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। 

হাঁটাহাঁটি করা: নিয়মিত হাঁটুন। খুবই গুরুত্বপূর্ন এটা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য। যত বেশি হাটবেন তত ক্যালরি বার্ন হবে তখন শরীরের অতিরিক্ত গ্লুকোজ ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন হবে। 

পর্যাপ্ত পানি পান করা: পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা ধরে রাখতে সহায়তা করতে পারে। একটি পর্যবেক্ষণ গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা বেশি পরিমাণে পানি পান করেন তাদের  রক্তে উচ্চ শর্করার বিকাশের ঝুঁকি কম থাকে

কম গ্লাইসেমিক (Glycemic) খাবার খান: বার্লি, দই, ওটস, মটরশুটি, মসুর ডাল, শাপলা, গম পাস্তা, অ-স্টার্চি সবজি ইতাদি কম গ্লাইসেমিক খাবার। (Low glycemic index food).

নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহন: নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহন ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে থাকে। 

ধূমপান না করা: ডায়াবেটিস রোগীদের এমনিতেই বহুমুখী রোগ হয়ে যায়। তাই ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। 

ডায়াবেটিসের চিকিৎসা 

ডায়াবেটিস রোগিদের চিকিৎসা সাধারণত ৩ টি উপায়ে করা হয় ।

১. খাদ্য তালিকার পরিবর্তন

২. জীবনযাপনের পরিবর্তন

৩. ঔষধ: Oral anti -Diabetic Drug, Insulin 

ডায়াবেটিসের ঔষধ 
  • মেটফরমিন
  • বাইগুয়ানাইডস
  • সালফোনাইলইউরিয়া
  • গ্লিপিজেড
  • ইনসুলিন

প্রতিটি ঔষধেরই হালকা কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন – অরুচি, বমি, হাইপোগ্লাইসেমিয়া। সালফোনাইলইউরিয়া এবং গ্লিপিজেড ওজন বাড়ায়। 

ডায়াবেটিস রোগীর খাবারের তালিকা

কোন খাবারই না খেতে বলা হচ্ছে না। তবে কিছু খাবারের ক্ষেত্রে কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নিয়ম মাফিক জীবনযাপনই ডায়েবিটিসকে বেঁধে রাখতে পারে। 

যে খাবারগুলো বেশি খাবেন

  • উপকারী চর্বি (Unsaturated fats) যেমন, বাদাম, অলিভ ওয়েল, মাছের তেল ইত্যাদি।
  • শাক সবজি ও ফলমূল– মূলত পরিষ্কার, টাটকা ও রঙিন শাকসবজি ভাল। 
  • দেশজ মাছ ও মুরগি অল্প পরিমাণে। 
  • ভাল প্রোটিন জাতীয় খাবার– যেমন, ডিম, অল্প চর্বি জাতীয় দুধ, টক দই ইত্যাদি।

যে খাবারগুলো কম খাবেন

  •  অতিরিক্ত মশলা দিয়ে রান্না করা খাবার
  •  ফাস্ট ফুড, বিশেষ করে যাতে চিনি, বেকিং করা খাবার, মিষ্টি, ডেজারট, চিপস ইত্যাদি থাকে।ড
  •  চিনিযুক্ত সেরিয়াল, প্রক্রিয়াজাত পাস্তা বা চাল
  • প্রক্রিয়াজাত মাছ বা মাংস

ভাত যত কম খেয়ে পারা যায়। সকালে ও রাতে ১-২ রুটি সাথে সবজি, দই, ফল। দুপুরে ১ কাপ ভাতের সাথে চর্বিমুক্ত মাছ কিংবা মাংস খুবই অল্প পরিমাণে ৫০ গ্রাম সাথে শাকসবজি। 

কি খেলে সুগার কমে

  • ব্রকলি
  • সামুদ্রিক মাছ
  • কুমড়া এবং কুমড়ার বীচি
  • বাদাম এবং বাদামের মাখন
  • ঢেঁড়স
  • শিম এবং শিমের বীচি
  • চিয়া সীড
  • বেরি
  • এভোকেডস
  • ওটস
  • সাইট্রাস ফল
  • ডিম

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে উপরের খাবার গুলো সুগার লেভেল কমাতে সাহায্য করে। এইসবের মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়েই ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা যায়। 

ডায়াবেটস একটি নিরব ঘাতক রোগ। উপরের আলোচনার মাধ্যমে ডায়াবেটিস কি? ডায়াবেটিসের লক্ষণ এবং ডায়াবেটিস কমানোর উপায় সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। আপনাদের কারো মধ্যে যদি এইসব লক্ষণ বা কারো যদি আগে থেকেই ডায়াবেটিস হয়ে থাকে তাহলে উপরের লেখাটি পরে আপনাদের কতটুকু উপকার হল তা আমাদের পাঠকদের সাথে শেয়ার করুন। 

Leave a Comment